বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১১

সরলরেখা-বক্ররেখা : পঞ্চম পর্ব

 
মিলিদের বিরাট বাসা। মিলির বাবা চাকুরী করেন, বেসরকারী একটা ব্যাংকে। মিলির দাদা এই বাড়ীর জায়গা কিনেছিলেন। ধানমন্ডির লেকের পাশে এখন আর তেমন একতলা দোতলা বাড়ী নেই। সবাই ডেভালপার দিয়ে কিংবা নিজেরাই সাত তলা এপার্টমেন্ট বানিয়ে নিয়েছেন। আজকাল ধানমন্ডিতে জায়গা কেনার কথা কোন ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারে না, প্রতিষ্ঠান যদি কিনতে পারে। মিলিদের জায়গা নিয়েও নানা কাহিনী ঘটেছে। কত ডেভালপার, কত প্রস্তাব দিয়েছেন। মিলির বাবা রাজী হয় নাই। মিলির বাবার যুক্তি একটাই, যাক না আরো কিছু দিন। হাবিবের ফুফু মাঝে মাঝে বলেছেন। চোখের সামনে কত কি দেখেছেন। এই ধানমন্ডিতে এখন অনেক যুবক আছে, যারা সারাদিনে কিছুই করে না। কিন্তু গাড়ী আছে একেকজনের দুই তিনটে করে। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায় ছেলে মেয়ে নিয়ে। বাবাদের রেখে যাওয়া জমি ওদের কোপাল ফিরিয়ে দিয়েছে। বাকী চৌদ্দ পরুষ বসে খেলেও টাকা ফুরাবে না অনেক পরিবারের। 

অনেক রাত পর্যন্ত হাবিবের সাথে কথা বলেছেন ফুফু। মা বাবা হারা ভাই বোন হাবিব সেলিনার প্রতি ফুফুর একটা আলাদা টান আছে। কথা যেন ফুরায় না। মাঝে মাঝে এসে মিলি উঁকি মেরে গিয়েছে। একবার এসে চা দিয়েছে। ফুফুর চোখ ফাঁকি দিয়ে হাবিব মিলিকে দেখে নেয়। কি যাদু লুকানো আছে। ফুফু চলে যাবার পর মিলি একবার এসে একটা কাগজ দিয়ে যায়। হাবিব খুলে দেখে একটা লাইন লেখা, কাল আপনাকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। 

হাবিবের ভাল ঘুম হয় নাই। ফুফুর বাসায় জামাই আদর পাচ্ছে বটে কিন্তু মনে পড়ে আছে ছোট বোনের সেলিনার কাছে। কি করে ও রাত পার করেছিলো। বাবা মা মারা যাবার পর বোন ছেড়ে এই প্রথম কোথায়ও রাত কাটালো হাবিব। মিলির টুকা চিঠির কথা মনে পড়তেই একটা হাসি এসে যায়, মিলি কি সত্যি তাকে পছন্দ করে। মনে মনে ভাবে, মিলি যদি তাকে পছন্দ না করে তবে কেন ঘুরার প্রস্তাব দিবে। দুয়ে দুয়ে চার মিলায় হাবিব। বন্ধু সিরাজ মিলনের কথাও মনে পড়ে। ওদের নিয়ে একবার ঢাকায় বেড়াতে আসতে হবে। অনেক মজা করা যাবে। 

দরজায় টোকার শব্দে হাবিব বিছানায় উঠে বসে। মিলির গলা শুনতে পায়। মিলি দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে।
; হাবিব ভাই, ঘুম ভাংছে! উঠে পড়ুন, নাস্তা খেতে আসুন।
- আসছি।
; বাথ রুমে সব দেয়া আছে। জলদি করে আসুন। আম্মা আপনার জন্য বসে আছে।

হাবিব বাথ রুমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ব্যাগ থেকে টুথব্রাশ ও পেষ্ট বের করে। টুথ পেষ্টের টিউবে চাপ দেয়। অনেক গুলো পেষ্ট বের হয়ে ব্রাশ উপছে মাটিতে পড়ে যায়। কি কারবার। বন্ধু মিলনের কথায় টুথপেষ্ট কিনেছিল। শুধু টুথব্রাশ নিয়ে আসতে চাইছিল হাবিব। বাথরুমে প্রবেশের পর মনে হল একবারে গোসল সেরে বের হলেই ভাল হবে। মিলিকে নিয়ে বের হতে চাইলে তাড়াতাড়ি করাই ভাল। ঝর্না ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হাবিব। বৃষ্টি ভেজার মত লাগছে। কতক্ষন পার হল কে জানে। মিলির গলা শুনে ঝর্নার চাবি বন্ধ করে।
; হাবিব ভাই, আর কতক্ষন লাগবে।

নূতন জিন্স প্যান্ট আর একটা টি শার্ট বের করে হাবিব। ঢাকা শহরে ভাল জামা কাপড় পরে বের হতে হবে। ঢাকা অনেক বড় শহর। অনেক কিছুই দেখতে হবে। বোন সেলিনাকে নিয়ে আসলেও অনেক মজা হত। ডাইনিং টেবিলে ফুফু বসে আছেন। ফুফুকে দেখে হাবিবের বাবার কথা মনে পড়ে। ফুফুর গায়ের রং আর তার বাবার গায়ের রং একই ধরনের। ভাই বোন বলে কথা। 

- ফুফু তোমাকে দেখলেই বাবার কথা মনে পড়ে।
; হা, আমরা তো দুই ভাইবোন পিঠাপিঠি ছিলাম। এক সাথেই মানুষ হয়েছি। এখন যেমন তুই আর সেলিনা বড় হয়ে যাচ্ছিস।

মিলির চাল চলনে বেশ আন্তরিকতা লক্ষ করে হাবিব। কলেজ ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ুয়া হিসাবে বেশ মানিয়ে আছে। এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে হাবিবের দিকে। মাঝে মাঝে হাবিবকে দেখে নিচ্ছে। নাস্তার টেবিলে বার কয়েক চোখাচুখি হয়েছে হাবিব মিলি। ফুফু নাস্তা শেষ করে উঠে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ান। চা নিজ হাতে বানাবেন। মিলি আর একটা পরটা হাবিবের প্লেটে তুলে দেয়। হাবিব আর নিতে চায় না। একজন কয়টা পরটা খেতে পারে! মিলি আরো জোর করে, আপনার জন্য আমি নিজে বানিয়েছি - নিন। 

মিলি আবার পরটা তুলে দেয়। মিলির হাত হাবিবের হাতে লেগে যায়। দুজনে হেসে উঠে। হাবিব বলে উঠে, ফুফুকে বলে দিব! মিলি নীরব হয়ে যায়। বাইরে চলুন, মজা দেখাব। হাবিবের মাথায় ধরে না, কি করে মিলির সাথে বাইরে বের হবে। ফুফু আবার কি মনে করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

; আমি আম্মাকে বলব কলেজে যাচ্ছি। আর আপনি বলবেন, ধানমন্ডি দেখতে বের হচ্ছেন। ব্যস। আপনি সোজা গিইয়ে বত্রিশ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন। 

হাবিব বের হয়ে একটা রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে হাটতে হাটতে সোজা বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট ধরালে মন্দ হত না। অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গা। লেকের পাড়ে সব কিছু সান বাঁধানো। দূরে কালো পাথরের গায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। বেদীতে অনেক ফুলের সমাহার। অনেক ফুল শুকিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছাসেবক লীগের ফুলের ঝালরটা এখনো তাজা। অনেক ছেলে মেয়ে আসছে। 

মিলি এসে পিঠে টোকা দেয়। কলেজ ড্রেসে মিলিকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। হাবিব মিলিকে বলে চল বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর ভিতরটা দেখে আসি। মিলি রিক্সা বিদায় দিয়ে দেয়। দুজনে বাড়ীটার দিকে এগিয়ে যায়। বাড়ীটা এখন একটা যাদুঘর। মিলি দুইবার বাড়ীটার ভিতরে গিয়েছিল। প্রায় দুইবছর আগে শেষবার গিয়েছিল। বাড়ীর সামনে এসে জানতে পারে আজ কোন দর্শনার্থীকে ভিতরে যেতে দেয়া হবে না কারন আজ ইন্ডিয়ার কোন এক অতিথি আসবেন। বড় কোন বিদেশী অতিথি আসলে দেশীদের আর প্রবেশাধিকার থাকে না!

হাবিবের মনে মনে ভাবে কাছেই তো, সময় করে আর একদিন এসে দেখে যাবে। মিলি হাবিবের বাহুতে চিমটি কাটে এখানে আর বেশী সময় দাঁড়ানো ঠিক হবে না। কোন আত্বীয় দেখে ফেললে বিশাল খবর হয়ে যাবে। হাবিব হাসে। তা হলে কোথায় যাওয়া যায়।

; সংসদ ভবনের দিকে ভাল হবে।

হাবিব সায় দেয়। সংসদ ভবন বাংলাদেশের একটা বিরাট স্থাপনা, ঢাকায় এসে না দেখে গেলে মনে কষ্ট থেকে যাবে। সংসদ অধিবেশন সম্প্রচারের জন্য এখন একটা আলাদা চ্যানেলও আছে। হাবিব মাঝে মাঝে দেখে। কত জ্ঞানীগুণী আলোচনা হয় এই ভবনে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।

ধানমন্ডি বত্রিশ রাস্তা থেকে বের হয়ে আসে হাবিব মিলি। একটু জোরে হাঁটতে হবে। এই পথে আবার রিক্সা চলে না। মিলি বলছিল রাস্তা পার হয়ে শুক্রাবাদের ভিতর দিয়ে রিক্সা নিয়ে ইন্দিরা রোড় হয়ে সংসদ ভবনের পূর্বকোন দিয়ে প্রবেশ করবে। তার পর ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবে। সময় থাকলে কোন গাছের ছায়ার কিছু সময় বসে কাটানো যাবে। দুপুরের আগে আবার বাসায় ফিরে আসতে হবে। 

নিউমার্কেট, সাইন্সল্যাব, ধানমন্ডি, কলাবাগান হয়ে মীরপুর চলে যাওয়া এই রাস্তা ঢাকার একটা বিশেষ ব্যস্ত রাস্তা। রাস্তা পারাপার হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু তবুও সাবাই পার হয়, হতে হয়। উপায় নেই। মিলি হাবিবের হাত ধরে এগিয়ে চলে। আগে রাস্তা পার হয়ে যেতে হবে। হাবিব ঢাকা শহরের এই ব্যস্ততা দেখে অবাক হয়। কত দ্রুত গাড়ী গুলো চালিয়ে চলে যাচ্ছে। 

রাস্তাতো ফাঁকাই ছিল, কোথা থেকে এই প্রাইভেট গাড়ীটা এগিয়ে এল। হাবিব মিলি বুঝতে পারছে না, আগে বাড়বে নাকি পিছনে যাবে। কিছু বুঝার আগেই প্রাইভেট গাড়ীটা ধাক্কা দেয় হাবিবকে। গড়িয়ে রাস্তায় পড়ে যায় হাবিব। মিলিও ছিটকে পড়ে। রক্তে ভেসে উঠে পথ। 

চিৎকার করে কাঁদতে থাকে মিলি।

1 টি মন্তব্য:

  1. http://www.choturmatrik.com/blogs/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A4-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%80/%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE-%E0%A6%AA%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%AE-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC

    উত্তরমুছুন

সরলরেখা-বক্ররেখা : পঞ্চম পর্ব

লিখেছেনঃ সাহাদাত উদরাজী (তারিখঃ ২৫ আগষ্ট ২০১১, ৬:৪১ পূর্বাহ্ন) সরলরেখা-বক্ররেখা : চতুর্থ পর্ব    মিলিদের বিরাট বাসা। মিলির বাবা চাকুরী ক...