রবিবার, ৫ জুন, ২০১১

জীবন সাথীঃ এক জোড়া মানুষ।

সকাল থেকে মন ভাল যাচ্ছিলো না। কি এক অজানা কষ্টে দুপুর পার হয়ে গেছে। কাজ কর্মে তেমন মনোযোগী ছিলাম না। ভাবলাম, দুপুরে ভাল খাবার খাই। আমার অফিস থেকে হাঁটা পথ ‘স্টার হোটেল’। স্টার হোটেল খাবার দাবারের ব্যাপারে ঢাকা শহরে নাম কামিয়েছে। এমন প্রেমিক প্রেমিকা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যারা স্টার কাবাব খায় নাই! টাকা কামিয়ে পুরাতন ঢাকা থেকে ধানমন্ডিতে বড় শাখা খুলেছে। ভাল মানের এবং পরিচ্ছন খাবার দাম দিয়ে খেতে মানুষের অভাব নেই। স্টার হোটেলে আরো কয়েকবার খেয়েছি, যখনই যাই মানুষের ভীড় চোখে পড়ে।

কোনায় একটা দুইজনের টেবিল ফাঁকা দেখে বসে পড়লাম। ওয়েটার ওয়ার্ডার নিতে আসতে পারছে না। ভীষন ব্যস্ততার মাঝে আছে। হোটেলে একা খেতে গেলে দাম পাওয়া যায় না। ওয়েটারা ভাবে, একজন মানুষ কি আর খাবে কিংবা কত টাকা টিপস দিবে! বেশী মানুষ নিয়ে গেলে ওরা হিসেবী কদর করে। স্যার স্যার বলে গলা শুকিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে হোটেল ওয়েটারদের মানসিকতা বদলানোর জন্য একটা কোচিং সেন্টার খোলা দরকার।

হোটেলে গেলেই ওয়েটার মনে করে, ব্যাটা জীবনে এই প্রথম হোটেলে এসেছে! ভাল খাবার জীবনে খায় নাই। আর সেজন্য প্রথমেই এক দমে কাচ্ছি বিরানী থেকে মুরগী মাসাল্লামে এসে থামে! সাক সবজি তো দূরে থাক, মাছের কথাও বলেতে চায় না। দামী খাবারে বিল বেশী, লজ্জায় হলেও তাকে বেশী টিপস দিতে হবে! ব্যাটারা এটা বুঝতে চায় না, আমাদের মত অনেক লোক আছে যারা বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন দুপুরে হোটেলে খাবার খায়। ঘর থাকতেও যারা পরবাসী!

সাদা ভাত, রুই মাছ আর পাতলা ডালের ওয়ার্ডার দিয়ে বসে আছি। মিনিট বিশেক পর হেলে দুলে ওয়েটার একবারেই সব নিয়ে এল। বেশ কৌশলী ওয়েটার, এত কিছু একবারেই দুই হাতে করে নিয়ে এসেছে। খাবার সাজিয়ে পানির কথা জানতে চায়, ঠান্ডা না নরমাল। এই গরমে ঠান্ডা হলেই ভাল হবে। তা ছাড়া আমার টনসিলাইটিস সমস্যা নেই! যত ঠান্ডা পারেন নিয়ে আসেন।

রুই মাছের পেটির টুকরাতে হাত লাগিয়ে কাটা দেখছিলাম। আমার পাশের টেবিলেই এক জোড়া মানুষ বসেছেন, একজন নারী, অন্যজন পুরুষ। এদের মধ্যে সম্পর্ক কি হতে পারে, বুঝা কিংবা আন্দাজ করা মুশকিল। খুবই আন্তরিক মনে হচ্ছে দুইজনকে। ছেলেটার সাথে মেয়েটাকে মানিয়েছে ভাল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জিন্স প্যান্ট ও গায়ে আকাশী রঙের টি সার্টে ছেলেটাকে ছবির নায়কের মতই মনে হচ্ছে।

আমার বসার জায়গা থেকে মেয়েটাকে খুব করে দেখা যায় না। উলটা করে বসা। তবে খোলা লম্বা চুল এবং দুই একবার মুখ ফেরানোর সময় চোহারা দেখেছি। বেশ সুন্দর। মেয়েটি হারিয়ে গেলে অনায়েশে পত্রিকায় এমন একটা বিজ্ঞপ্তি দেয়া যায় - মেয়েটির গায়ের রঙ শ্যামলা, মুখমণ্ডল গোলাকার, বয়স আনুমানিক পঁচিশ, উচ্চতা পাঁচ ফিট দুই। সোজা এক কথায় মায়াবী চেহারা।

এরা জীবন সাথী, প্রেমিক প্রেমিকা, স্বামী স্ত্রী না অন্য কিছু! খেতে খেতে ভাবছিলাম। রুই মাছের ঝোল না তেল! এটা হোটেল ওয়ালাদের কে বুঝাবে! এত তেল দিয়ে রান্না খাবার খেলে মানুষ বেশী দিন বাঁচে না রে পাগল! হার্ট, লিভার, কিডনী, রেক্টাম সহ শরীরের নানা অঙ্গে নানা অসুখ বাঁধে। সাদা ভাতে ডাল নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। আমি খাবার তাড়াতাড়ি খাই, সময় বাঁচানোর জন্য। খেতে বসে দুনিয়ার ফালতু আলাপের ঘোর বিরোধী আমি। আমার জীবন সংগী এ ব্যাপারে দারুন উলটা! আমি দুই ফুল প্লেট ভাত খেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে পনর মিনিট বিটিভি সংবাদ দেখে আসলেও দেখি তিনি চামুচ দিয়ে তরকারী নিচ্ছেন! সবই কপাল। তের বছরে তেরটা নৈতিকদিক বুঝাতে পারলাম না।

যাক। জীবন আসলে কারো জন্য থেমে থাকে না। রিঝিকের মালিক আল্লাহপাক। বাসায় রান্না না হলে রিঝিক হোটেল লিখা থাকে! কোথায় না কোথায় থাকবেই। মানুষ এই ভরশা নিয়েই বেঁচে থাকে। নানা ভাবনার ভীড়েও আমি মাঝে মাঝে ওই জোড়া মানুষ গুলো দেখছিলাম। ওদের খাওয়া শেষ, ওয়েটারকে বিল পরিশোধ করছে। উঠি উঠি করছে, আমিও শেষের দিকে আছি। ডালটা বেশ স্বাদের হয়েছে। বাসা হলে আর এক বাটী নিয়ে স্যুপের মত করে চালান দিতাম। হোটেলে ডাল এমন করে খেলে লোকে হাসবে! আর যদি মেয়েটা দেখে, লজ্জার সীমা থাকবে না! একটা ভাল লাগায় মনটা ভরে উঠছিল। সুখী মানুষ দেখলে ভাল লাগে।

একি। মেয়েটা যে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। টেবিলের তলায় রাখা দুটো ক্র্যাচ এগিয়ে দিচ্ছে ছেলেটা। ছেলেটা মেয়েটাকে ধরে দাঁড়া করিয়ে দিল। দুই হাতে দুটো ক্র্যাচ চেপে মেয়েটা এগিয়ে চলল। ওরা এগিয়ে যেতে থাকে। হায়, একি মেয়েটার একটা পা নেই!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সরলরেখা-বক্ররেখা : পঞ্চম পর্ব

লিখেছেনঃ সাহাদাত উদরাজী (তারিখঃ ২৫ আগষ্ট ২০১১, ৬:৪১ পূর্বাহ্ন) সরলরেখা-বক্ররেখা : চতুর্থ পর্ব    মিলিদের বিরাট বাসা। মিলির বাবা চাকুরী ক...