রবিবার, ৫ জুন, ২০১১

জীবন সাথীঃ জীবিকা অথবা জীবন- ৯ (জুলিয়ান সিদ্দিকী)

সকালে হাটতে বের হয়েছেন রহমান সাহেব। আজকাল দুবেলা করে হাটেন, এতে যদি কিছু দিন বেশী বাচা যায় মন্দ কি! দুনিয়া থেকে চলে গেলে তো সব শেষ। তার চেয়ে কিছু দিন বেশী বাচার চেষ্টা করা সবার উচিত। এই পৃথিবীর রঙ্গশালায় যত দিন অভিনয় করে মজা পাওয়া যায় ততই লাভ!

পথিমধ্য বাল্যবন্ধু ডাক্তার শৈলেশ বর্মনকে পেয়ে গেলেন। কি রে কেমন আছিস? আজকাল তো আর দেখা পাচ্ছি না। সে কবে স্যালাইন দিয়ে ঘুমপাড়িয়ে রেখে এসেছিস আর তো এলি না। তোরা ডাক্তারাও পারিস বটে! দিনে এত রোগী দেখিস কেন। যত গুলো রোগী দেখিস তাদের বর্তমান কি হালচাল, কে আছে, কে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছে তা জানতে ইচ্ছা হয় না।

ডাক্তার শৈলেশ বাবু রহমান সাহেবের কথা শুনছিলেন। আসলে বলার কি আছে? রহমানের কথা তো সত্যি। দিনে যদি একজন ডাক্তার পাঞ্চাশ/ষাট জন রোগী দেখে তবে ডাক্তার মশাই কাকে কাকে মনে রাখবে। আজ দিনে তার দেখা কেন রোগী মারা গেছে তা জানবে কি করে।
কি রে কথা বলিস না কেন? বাঁচাল হিসাবে ডাক্তার শৈলেশ বর্মনের যে একটা স্থান আছে তা মনে হয় ডাক্তার শৈলেশ বর্মন আজ হারিয়ে ফেলেছেন।

কি আর বলবো। তোর কথা সবই সত্যি। এতে বলার কি আছে। টাকার পিছে পিছে ছুটে ছুটে আমরা তো বিবেক হারিয়েছি। আমাদের শুধু টাকা চাই।

রহমান সাহেব এগিয়ে চলেন, জোরে কদম ফেলেন। আজ অনেকদুর হাটতে হবে। শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে হবে। বাসায় সালমা বেগমকে বলে এসেছেন, গরুর মাংশের কাবাব বানাতে। সকালের নাস্তায় আজ পরটা দিয়ে গরুর মাংশের কাবাব খাবেন। পরটা কাবাব সাধারণত আমাদের দেশের বিকালের খাবার। সালমা বেগম রহমান সাহেবের খাবার দাবারের পছন্দকে একটা বাড়াবাড়ি মনে করতেন একসময়। কিন্তু দুইজনে বুড়ো হয়ে যাওয়ায় এখন আর তা মনে করেন না। যতদিন বাঁচি, খেয়ে বাঁচি। আর রেখে, জমিয়ে কি লাভ। ছেলেমেয়েরা তাদের নিজের পথ নিজে ধরে ফেলেছে।

বাসার কাছাকাছি আসতে রহমান সাহেবের মনে হল, মনু মিয়া কই। ওকে বাজারে পাঠাতে হবে। কিছু ছোট শিংমাছ আনলে ভাল হত। আজ দুপুরে পালংশাক দিয়ে শিংমাছের ঝোল মন্দ হবে না। সালমা বেগমের রান্নার জুড়ি নেই। তবে ছোট শিংমাছ কাটাকাটি অনেক কস্টকর কাজ। কাটার পর আবার ডলেডলে মাছের চামড়া সাদা করাও কঠিন। সালমা বেগম আজকাল এমন ছোট এবং আকাটা মাছ নিয়ে বাসায় ফিরলে বকাবাদ্য করেন। মনু মিয়াকে পেলেন না। কাজের সময় এমনি হয়। কে যে কই যায়।

হাত মুখে পানি দিয়ে নাস্তার টেবিলে বসলেন রহমান সাহেব। সালমা, হলো কি। সালমা বেগম বললেন আরো দুইচার মিনিট দেরী হবে। রহমান সাহেব পেপারটা নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলেন, ‘প্রথম আলো’ দৈনিকটার নামটা অসম্ভব সুন্দর। কে যে নামটা রেখেছিল। প্রথম আলোতে কাজ করা কোন সংবাদিক পেলে জানতে হবে। কে এই নামটা বের করেছিল। বংলাদেশের সব ঘটনার মত এটাও এমন হতে পারে, যে নামটা বের করেছে, সে হয়ত এখন দুবেলা খেতে পায় না। আর তার দেয়া নামটা নিয়ে অন্যরা গাড়ী চালিয়ে বেড়াচ্ছে।

আজ দৈনিক প্রথম আলোতে অস্ট্রেলিয়ার বন্যা নিয়ে ছবি সহ নানা খবর ছাপিয়েছে। রহমান সাহবের অস্ট্রেলিয়ার জন্য করুনা হয়। বন্যা তো হবে বাংলাদেশে, অস্ট্রেলিয়াতে কেন হল। যত দুঃখ সব তো বাংলাদেশের কপালে লিখা থাকে। বন্যার দৃশ্যগুলো দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। ইস কি ভয়াবহ, বাড়ীঘর অধেক ডুবে আছে। কি কষ্টে আছে মানুষ গুলো!

সালমা নাস্তা নিয়ে আসেন। খাও, পেট পুরে। সালমা মাঝে মাঝে রেগে রেগে কথা বলে অহেতুক। কি কারনে আল্লাহ জানেন! বিশেষ কিছু রান্নায় বিরক্তির পরিমান বেশী, তবে বানিয়ে দেন। গত ত্রিশ বছর এমন সয়ে আসছেন রহমান সাহেব। কথা না বাড়িয়ে পরটা চিঁড়ে মুখে পুরেন। কাবাব গুলো থেকে গরম গরম ধোয়া বেব হচ্ছে। মনে হয় বেশ ভাল হয়েছে, হাসিমুখে সালমা বেগমের দিকে তাকান। সালমা বেগম হাসেন, ভাল খাবার হলে তো মুখে কথা নাই!

চা কাপ নামিয়ে রহমান সাহেব জোরে হাসেন। দুনিয়ার এ এক মজার খেলা। স্বামী স্ত্রী। স্বামী এক পক্ষে আর অন্য পক্ষে স্ত্রী! কখনো রাগের খেলা, কখনো অভিমানের খেলা, কখনো কান্না, কখনো হাসির খেলা!

অন্যকাজ কর্ম নেই আজ। পত্রিকা নিয়ে বেডরুমের দিকে চলে গেলেন। জানালা খুলে আলোর ব্যবস্থা করে দেখলেন হালকা শীতেব বাতাস বইছে। হালকা শীতে গায়ে কম্বল চেপে শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়া যাক। দুইএকটা মশা ভ্যো ভ্যো করে উড়ে আসছে যাচ্ছে। আজকাল মশাগুলোর স্বভাবও পাল্টে গেছে। দিনেও মানুষকে কামড়াতে চায়। কিছুক্ষন পড়ার পর চোখ দুটো ভেঙ্গে এলো, পুরো ঘুমের রাজ্যে চলে গেলেন রহমান সাহেব। মশার জালায় পুরো মাথা ডেকে নিয়েছিলেন কম্বলে।

কিছুক্ষন কিংবা কয়েক ঘণ্টা পরে সালমা বেগম কি মনে করে রহমান সাহেবকে দেখতে এলেন। মানুষটা করে কি! একি, কম্বলে মুখ ডাকা রহমান সাহেব হাত পা নাড়াছেন কেন? সালমা বেগম এগিয়ে যান। এক টানে মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে দেন। কি হল, এমন করছ কেন? এমন দাপড়া দাপড়ি। লা ইল্লাহ বলে উঠে বসেন রহমান সাহেব। সালমা বেগমকে দেখে যেন প্রানে পানি পেয়েছেন। ঘেমে যাচ্ছেন।

ঘটনাটা খুলে বলেন সালমা বেগমকে। তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। দেখছিলেন, চারিদিকে বন্যার পানি আর পানি। হটাত একটা শিশু পানিতে পড়ে গিয়েছিল। তাকে বাঁচাতে তিনিও পানিতে ঝাপ দিয়েছিলেন। শিশুটিকে কেন রকমে কুলে তুলে দিলেও তিনি আর নিজকে বাচাতে পারছিলেন না। ডুবে যেতে যেতে শেষ চেষ্টা করছিলেন। হাত দুটো দিয়ে কোন রকমেও পানি কেটে উপরে উঠতে পারছিলেন না। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিলো। জানো সালমা, মৃত্যু কি ভীষন কষ্টের। মনে হচ্ছিলো কি যেন একটা কিছু দেহ থেকে বের হয়ে যাবে - এক্ষুনি।

সালমা বেগম রহমান সাহেবের আরো কাছে এসে বসেন।

(প্রথম প্রকাশঃ আমরা বন্ধু)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সরলরেখা-বক্ররেখা : পঞ্চম পর্ব

লিখেছেনঃ সাহাদাত উদরাজী (তারিখঃ ২৫ আগষ্ট ২০১১, ৬:৪১ পূর্বাহ্ন) সরলরেখা-বক্ররেখা : চতুর্থ পর্ব    মিলিদের বিরাট বাসা। মিলির বাবা চাকুরী ক...