বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১১

সরলরেখা-বক্ররেখা : পঞ্চম পর্ব

 
মিলিদের বিরাট বাসা। মিলির বাবা চাকুরী করেন, বেসরকারী একটা ব্যাংকে। মিলির দাদা এই বাড়ীর জায়গা কিনেছিলেন। ধানমন্ডির লেকের পাশে এখন আর তেমন একতলা দোতলা বাড়ী নেই। সবাই ডেভালপার দিয়ে কিংবা নিজেরাই সাত তলা এপার্টমেন্ট বানিয়ে নিয়েছেন। আজকাল ধানমন্ডিতে জায়গা কেনার কথা কোন ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারে না, প্রতিষ্ঠান যদি কিনতে পারে। মিলিদের জায়গা নিয়েও নানা কাহিনী ঘটেছে। কত ডেভালপার, কত প্রস্তাব দিয়েছেন। মিলির বাবা রাজী হয় নাই। মিলির বাবার যুক্তি একটাই, যাক না আরো কিছু দিন। হাবিবের ফুফু মাঝে মাঝে বলেছেন। চোখের সামনে কত কি দেখেছেন। এই ধানমন্ডিতে এখন অনেক যুবক আছে, যারা সারাদিনে কিছুই করে না। কিন্তু গাড়ী আছে একেকজনের দুই তিনটে করে। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায় ছেলে মেয়ে নিয়ে। বাবাদের রেখে যাওয়া জমি ওদের কোপাল ফিরিয়ে দিয়েছে। বাকী চৌদ্দ পরুষ বসে খেলেও টাকা ফুরাবে না অনেক পরিবারের। 

অনেক রাত পর্যন্ত হাবিবের সাথে কথা বলেছেন ফুফু। মা বাবা হারা ভাই বোন হাবিব সেলিনার প্রতি ফুফুর একটা আলাদা টান আছে। কথা যেন ফুরায় না। মাঝে মাঝে এসে মিলি উঁকি মেরে গিয়েছে। একবার এসে চা দিয়েছে। ফুফুর চোখ ফাঁকি দিয়ে হাবিব মিলিকে দেখে নেয়। কি যাদু লুকানো আছে। ফুফু চলে যাবার পর মিলি একবার এসে একটা কাগজ দিয়ে যায়। হাবিব খুলে দেখে একটা লাইন লেখা, কাল আপনাকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। 

হাবিবের ভাল ঘুম হয় নাই। ফুফুর বাসায় জামাই আদর পাচ্ছে বটে কিন্তু মনে পড়ে আছে ছোট বোনের সেলিনার কাছে। কি করে ও রাত পার করেছিলো। বাবা মা মারা যাবার পর বোন ছেড়ে এই প্রথম কোথায়ও রাত কাটালো হাবিব। মিলির টুকা চিঠির কথা মনে পড়তেই একটা হাসি এসে যায়, মিলি কি সত্যি তাকে পছন্দ করে। মনে মনে ভাবে, মিলি যদি তাকে পছন্দ না করে তবে কেন ঘুরার প্রস্তাব দিবে। দুয়ে দুয়ে চার মিলায় হাবিব। বন্ধু সিরাজ মিলনের কথাও মনে পড়ে। ওদের নিয়ে একবার ঢাকায় বেড়াতে আসতে হবে। অনেক মজা করা যাবে। 

দরজায় টোকার শব্দে হাবিব বিছানায় উঠে বসে। মিলির গলা শুনতে পায়। মিলি দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে।
; হাবিব ভাই, ঘুম ভাংছে! উঠে পড়ুন, নাস্তা খেতে আসুন।
- আসছি।
; বাথ রুমে সব দেয়া আছে। জলদি করে আসুন। আম্মা আপনার জন্য বসে আছে।

হাবিব বাথ রুমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ব্যাগ থেকে টুথব্রাশ ও পেষ্ট বের করে। টুথ পেষ্টের টিউবে চাপ দেয়। অনেক গুলো পেষ্ট বের হয়ে ব্রাশ উপছে মাটিতে পড়ে যায়। কি কারবার। বন্ধু মিলনের কথায় টুথপেষ্ট কিনেছিল। শুধু টুথব্রাশ নিয়ে আসতে চাইছিল হাবিব। বাথরুমে প্রবেশের পর মনে হল একবারে গোসল সেরে বের হলেই ভাল হবে। মিলিকে নিয়ে বের হতে চাইলে তাড়াতাড়ি করাই ভাল। ঝর্না ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হাবিব। বৃষ্টি ভেজার মত লাগছে। কতক্ষন পার হল কে জানে। মিলির গলা শুনে ঝর্নার চাবি বন্ধ করে।
; হাবিব ভাই, আর কতক্ষন লাগবে।

নূতন জিন্স প্যান্ট আর একটা টি শার্ট বের করে হাবিব। ঢাকা শহরে ভাল জামা কাপড় পরে বের হতে হবে। ঢাকা অনেক বড় শহর। অনেক কিছুই দেখতে হবে। বোন সেলিনাকে নিয়ে আসলেও অনেক মজা হত। ডাইনিং টেবিলে ফুফু বসে আছেন। ফুফুকে দেখে হাবিবের বাবার কথা মনে পড়ে। ফুফুর গায়ের রং আর তার বাবার গায়ের রং একই ধরনের। ভাই বোন বলে কথা। 

- ফুফু তোমাকে দেখলেই বাবার কথা মনে পড়ে।
; হা, আমরা তো দুই ভাইবোন পিঠাপিঠি ছিলাম। এক সাথেই মানুষ হয়েছি। এখন যেমন তুই আর সেলিনা বড় হয়ে যাচ্ছিস।

মিলির চাল চলনে বেশ আন্তরিকতা লক্ষ করে হাবিব। কলেজ ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ুয়া হিসাবে বেশ মানিয়ে আছে। এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে হাবিবের দিকে। মাঝে মাঝে হাবিবকে দেখে নিচ্ছে। নাস্তার টেবিলে বার কয়েক চোখাচুখি হয়েছে হাবিব মিলি। ফুফু নাস্তা শেষ করে উঠে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ান। চা নিজ হাতে বানাবেন। মিলি আর একটা পরটা হাবিবের প্লেটে তুলে দেয়। হাবিব আর নিতে চায় না। একজন কয়টা পরটা খেতে পারে! মিলি আরো জোর করে, আপনার জন্য আমি নিজে বানিয়েছি - নিন। 

মিলি আবার পরটা তুলে দেয়। মিলির হাত হাবিবের হাতে লেগে যায়। দুজনে হেসে উঠে। হাবিব বলে উঠে, ফুফুকে বলে দিব! মিলি নীরব হয়ে যায়। বাইরে চলুন, মজা দেখাব। হাবিবের মাথায় ধরে না, কি করে মিলির সাথে বাইরে বের হবে। ফুফু আবার কি মনে করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

; আমি আম্মাকে বলব কলেজে যাচ্ছি। আর আপনি বলবেন, ধানমন্ডি দেখতে বের হচ্ছেন। ব্যস। আপনি সোজা গিইয়ে বত্রিশ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন। 

হাবিব বের হয়ে একটা রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে হাটতে হাটতে সোজা বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট ধরালে মন্দ হত না। অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গা। লেকের পাড়ে সব কিছু সান বাঁধানো। দূরে কালো পাথরের গায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। বেদীতে অনেক ফুলের সমাহার। অনেক ফুল শুকিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছাসেবক লীগের ফুলের ঝালরটা এখনো তাজা। অনেক ছেলে মেয়ে আসছে। 

মিলি এসে পিঠে টোকা দেয়। কলেজ ড্রেসে মিলিকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। হাবিব মিলিকে বলে চল বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর ভিতরটা দেখে আসি। মিলি রিক্সা বিদায় দিয়ে দেয়। দুজনে বাড়ীটার দিকে এগিয়ে যায়। বাড়ীটা এখন একটা যাদুঘর। মিলি দুইবার বাড়ীটার ভিতরে গিয়েছিল। প্রায় দুইবছর আগে শেষবার গিয়েছিল। বাড়ীর সামনে এসে জানতে পারে আজ কোন দর্শনার্থীকে ভিতরে যেতে দেয়া হবে না কারন আজ ইন্ডিয়ার কোন এক অতিথি আসবেন। বড় কোন বিদেশী অতিথি আসলে দেশীদের আর প্রবেশাধিকার থাকে না!

হাবিবের মনে মনে ভাবে কাছেই তো, সময় করে আর একদিন এসে দেখে যাবে। মিলি হাবিবের বাহুতে চিমটি কাটে এখানে আর বেশী সময় দাঁড়ানো ঠিক হবে না। কোন আত্বীয় দেখে ফেললে বিশাল খবর হয়ে যাবে। হাবিব হাসে। তা হলে কোথায় যাওয়া যায়।

; সংসদ ভবনের দিকে ভাল হবে।

হাবিব সায় দেয়। সংসদ ভবন বাংলাদেশের একটা বিরাট স্থাপনা, ঢাকায় এসে না দেখে গেলে মনে কষ্ট থেকে যাবে। সংসদ অধিবেশন সম্প্রচারের জন্য এখন একটা আলাদা চ্যানেলও আছে। হাবিব মাঝে মাঝে দেখে। কত জ্ঞানীগুণী আলোচনা হয় এই ভবনে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।

ধানমন্ডি বত্রিশ রাস্তা থেকে বের হয়ে আসে হাবিব মিলি। একটু জোরে হাঁটতে হবে। এই পথে আবার রিক্সা চলে না। মিলি বলছিল রাস্তা পার হয়ে শুক্রাবাদের ভিতর দিয়ে রিক্সা নিয়ে ইন্দিরা রোড় হয়ে সংসদ ভবনের পূর্বকোন দিয়ে প্রবেশ করবে। তার পর ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবে। সময় থাকলে কোন গাছের ছায়ার কিছু সময় বসে কাটানো যাবে। দুপুরের আগে আবার বাসায় ফিরে আসতে হবে। 

নিউমার্কেট, সাইন্সল্যাব, ধানমন্ডি, কলাবাগান হয়ে মীরপুর চলে যাওয়া এই রাস্তা ঢাকার একটা বিশেষ ব্যস্ত রাস্তা। রাস্তা পারাপার হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু তবুও সাবাই পার হয়, হতে হয়। উপায় নেই। মিলি হাবিবের হাত ধরে এগিয়ে চলে। আগে রাস্তা পার হয়ে যেতে হবে। হাবিব ঢাকা শহরের এই ব্যস্ততা দেখে অবাক হয়। কত দ্রুত গাড়ী গুলো চালিয়ে চলে যাচ্ছে। 

রাস্তাতো ফাঁকাই ছিল, কোথা থেকে এই প্রাইভেট গাড়ীটা এগিয়ে এল। হাবিব মিলি বুঝতে পারছে না, আগে বাড়বে নাকি পিছনে যাবে। কিছু বুঝার আগেই প্রাইভেট গাড়ীটা ধাক্কা দেয় হাবিবকে। গড়িয়ে রাস্তায় পড়ে যায় হাবিব। মিলিও ছিটকে পড়ে। রক্তে ভেসে উঠে পথ। 

চিৎকার করে কাঁদতে থাকে মিলি।

রবিবার, ৫ জুন, ২০১১

জীবন সাথীঃ জীবিকা অথবা জীবন- ৯ (জুলিয়ান সিদ্দিকী)

সকালে হাটতে বের হয়েছেন রহমান সাহেব। আজকাল দুবেলা করে হাটেন, এতে যদি কিছু দিন বেশী বাচা যায় মন্দ কি! দুনিয়া থেকে চলে গেলে তো সব শেষ। তার চেয়ে কিছু দিন বেশী বাচার চেষ্টা করা সবার উচিত। এই পৃথিবীর রঙ্গশালায় যত দিন অভিনয় করে মজা পাওয়া যায় ততই লাভ!

পথিমধ্য বাল্যবন্ধু ডাক্তার শৈলেশ বর্মনকে পেয়ে গেলেন। কি রে কেমন আছিস? আজকাল তো আর দেখা পাচ্ছি না। সে কবে স্যালাইন দিয়ে ঘুমপাড়িয়ে রেখে এসেছিস আর তো এলি না। তোরা ডাক্তারাও পারিস বটে! দিনে এত রোগী দেখিস কেন। যত গুলো রোগী দেখিস তাদের বর্তমান কি হালচাল, কে আছে, কে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছে তা জানতে ইচ্ছা হয় না।

ডাক্তার শৈলেশ বাবু রহমান সাহেবের কথা শুনছিলেন। আসলে বলার কি আছে? রহমানের কথা তো সত্যি। দিনে যদি একজন ডাক্তার পাঞ্চাশ/ষাট জন রোগী দেখে তবে ডাক্তার মশাই কাকে কাকে মনে রাখবে। আজ দিনে তার দেখা কেন রোগী মারা গেছে তা জানবে কি করে।
কি রে কথা বলিস না কেন? বাঁচাল হিসাবে ডাক্তার শৈলেশ বর্মনের যে একটা স্থান আছে তা মনে হয় ডাক্তার শৈলেশ বর্মন আজ হারিয়ে ফেলেছেন।

কি আর বলবো। তোর কথা সবই সত্যি। এতে বলার কি আছে। টাকার পিছে পিছে ছুটে ছুটে আমরা তো বিবেক হারিয়েছি। আমাদের শুধু টাকা চাই।

রহমান সাহেব এগিয়ে চলেন, জোরে কদম ফেলেন। আজ অনেকদুর হাটতে হবে। শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে হবে। বাসায় সালমা বেগমকে বলে এসেছেন, গরুর মাংশের কাবাব বানাতে। সকালের নাস্তায় আজ পরটা দিয়ে গরুর মাংশের কাবাব খাবেন। পরটা কাবাব সাধারণত আমাদের দেশের বিকালের খাবার। সালমা বেগম রহমান সাহেবের খাবার দাবারের পছন্দকে একটা বাড়াবাড়ি মনে করতেন একসময়। কিন্তু দুইজনে বুড়ো হয়ে যাওয়ায় এখন আর তা মনে করেন না। যতদিন বাঁচি, খেয়ে বাঁচি। আর রেখে, জমিয়ে কি লাভ। ছেলেমেয়েরা তাদের নিজের পথ নিজে ধরে ফেলেছে।

বাসার কাছাকাছি আসতে রহমান সাহেবের মনে হল, মনু মিয়া কই। ওকে বাজারে পাঠাতে হবে। কিছু ছোট শিংমাছ আনলে ভাল হত। আজ দুপুরে পালংশাক দিয়ে শিংমাছের ঝোল মন্দ হবে না। সালমা বেগমের রান্নার জুড়ি নেই। তবে ছোট শিংমাছ কাটাকাটি অনেক কস্টকর কাজ। কাটার পর আবার ডলেডলে মাছের চামড়া সাদা করাও কঠিন। সালমা বেগম আজকাল এমন ছোট এবং আকাটা মাছ নিয়ে বাসায় ফিরলে বকাবাদ্য করেন। মনু মিয়াকে পেলেন না। কাজের সময় এমনি হয়। কে যে কই যায়।

হাত মুখে পানি দিয়ে নাস্তার টেবিলে বসলেন রহমান সাহেব। সালমা, হলো কি। সালমা বেগম বললেন আরো দুইচার মিনিট দেরী হবে। রহমান সাহেব পেপারটা নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলেন, ‘প্রথম আলো’ দৈনিকটার নামটা অসম্ভব সুন্দর। কে যে নামটা রেখেছিল। প্রথম আলোতে কাজ করা কোন সংবাদিক পেলে জানতে হবে। কে এই নামটা বের করেছিল। বংলাদেশের সব ঘটনার মত এটাও এমন হতে পারে, যে নামটা বের করেছে, সে হয়ত এখন দুবেলা খেতে পায় না। আর তার দেয়া নামটা নিয়ে অন্যরা গাড়ী চালিয়ে বেড়াচ্ছে।

আজ দৈনিক প্রথম আলোতে অস্ট্রেলিয়ার বন্যা নিয়ে ছবি সহ নানা খবর ছাপিয়েছে। রহমান সাহবের অস্ট্রেলিয়ার জন্য করুনা হয়। বন্যা তো হবে বাংলাদেশে, অস্ট্রেলিয়াতে কেন হল। যত দুঃখ সব তো বাংলাদেশের কপালে লিখা থাকে। বন্যার দৃশ্যগুলো দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। ইস কি ভয়াবহ, বাড়ীঘর অধেক ডুবে আছে। কি কষ্টে আছে মানুষ গুলো!

সালমা নাস্তা নিয়ে আসেন। খাও, পেট পুরে। সালমা মাঝে মাঝে রেগে রেগে কথা বলে অহেতুক। কি কারনে আল্লাহ জানেন! বিশেষ কিছু রান্নায় বিরক্তির পরিমান বেশী, তবে বানিয়ে দেন। গত ত্রিশ বছর এমন সয়ে আসছেন রহমান সাহেব। কথা না বাড়িয়ে পরটা চিঁড়ে মুখে পুরেন। কাবাব গুলো থেকে গরম গরম ধোয়া বেব হচ্ছে। মনে হয় বেশ ভাল হয়েছে, হাসিমুখে সালমা বেগমের দিকে তাকান। সালমা বেগম হাসেন, ভাল খাবার হলে তো মুখে কথা নাই!

চা কাপ নামিয়ে রহমান সাহেব জোরে হাসেন। দুনিয়ার এ এক মজার খেলা। স্বামী স্ত্রী। স্বামী এক পক্ষে আর অন্য পক্ষে স্ত্রী! কখনো রাগের খেলা, কখনো অভিমানের খেলা, কখনো কান্না, কখনো হাসির খেলা!

অন্যকাজ কর্ম নেই আজ। পত্রিকা নিয়ে বেডরুমের দিকে চলে গেলেন। জানালা খুলে আলোর ব্যবস্থা করে দেখলেন হালকা শীতেব বাতাস বইছে। হালকা শীতে গায়ে কম্বল চেপে শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়া যাক। দুইএকটা মশা ভ্যো ভ্যো করে উড়ে আসছে যাচ্ছে। আজকাল মশাগুলোর স্বভাবও পাল্টে গেছে। দিনেও মানুষকে কামড়াতে চায়। কিছুক্ষন পড়ার পর চোখ দুটো ভেঙ্গে এলো, পুরো ঘুমের রাজ্যে চলে গেলেন রহমান সাহেব। মশার জালায় পুরো মাথা ডেকে নিয়েছিলেন কম্বলে।

কিছুক্ষন কিংবা কয়েক ঘণ্টা পরে সালমা বেগম কি মনে করে রহমান সাহেবকে দেখতে এলেন। মানুষটা করে কি! একি, কম্বলে মুখ ডাকা রহমান সাহেব হাত পা নাড়াছেন কেন? সালমা বেগম এগিয়ে যান। এক টানে মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে দেন। কি হল, এমন করছ কেন? এমন দাপড়া দাপড়ি। লা ইল্লাহ বলে উঠে বসেন রহমান সাহেব। সালমা বেগমকে দেখে যেন প্রানে পানি পেয়েছেন। ঘেমে যাচ্ছেন।

ঘটনাটা খুলে বলেন সালমা বেগমকে। তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। দেখছিলেন, চারিদিকে বন্যার পানি আর পানি। হটাত একটা শিশু পানিতে পড়ে গিয়েছিল। তাকে বাঁচাতে তিনিও পানিতে ঝাপ দিয়েছিলেন। শিশুটিকে কেন রকমে কুলে তুলে দিলেও তিনি আর নিজকে বাচাতে পারছিলেন না। ডুবে যেতে যেতে শেষ চেষ্টা করছিলেন। হাত দুটো দিয়ে কোন রকমেও পানি কেটে উপরে উঠতে পারছিলেন না। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিলো। জানো সালমা, মৃত্যু কি ভীষন কষ্টের। মনে হচ্ছিলো কি যেন একটা কিছু দেহ থেকে বের হয়ে যাবে - এক্ষুনি।

সালমা বেগম রহমান সাহেবের আরো কাছে এসে বসেন।

(প্রথম প্রকাশঃ আমরা বন্ধু)

জীবন সাথীঃ জীবনের দুই ঘটনা।

১।
ঘটনা অনেক আগের, আপনাদের এই ঢাকা শহরের। বিবাহ করে জীবন সাথীকে নিয়ে সুখে দিনাতিপাত করছিল। টাকা পয়সার ব্যাপক প্রযোজনীয়তা তখনো নেই। জীবন একটা সাধারন চাকুরী করে, যা পায় তা দিয়ে কোন রকমে চলে যাচ্ছিলো। দুইজনই যেহেতু নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে ঘর বেধেছিল তাই চাওয়া পাওয়াও কম ছিল। তবে মাসের শেষে বাজার খরচে একটা হালকা টান পড়ে যেত, শেষ দুই চারদিন জীবনের পকেটে টাকা থাকত না। সোজাকথা জীবন ও সাথীর জীবনবোধ তখনো চাঙ্গা হয় নাই। এমনি একদিনে দু’জনে রাতের খাবার খেতে বসে, মাদুর পেতে - ভাত, লাল মরিচভর্তা আর পানিডাল।

আসলে সাথীর সে দিন আর কিছু করার ছিল না, এর ছেয়ে আর বেশী কিছু রান্নার সামগ্রী তার হাতে ছিল না। সকালে জীবনকে তরুতরকারীর কথা বলেছিল। জীবনও বলেছিল, চেষ্টা করবে। জীবন সেটা পারে নাই, অফিসে কারো থেকে ধার করে নিবে ভেবেছিলো কিন্তু কেমন একটা লজ্জায় তা আর করে নাই। খালিহাতেই বাসায় ফিরে গিয়েছিল।

সাথী জীবনের পাতে ভাত তুলে দিয়ে মরিচভর্তা এগিয়ে দেয়। জীবন চামুচ দিয়ে মরিচভর্তা নিতে চেষ্টা করে, ভর্তার বাটি দোল খায়। এমন সময় সাথীর চোখে চোখ পড়ে যায় জীবনের। ফর্সা টুকটুকে সাথী হেসে ফেলে, আজ খেয়ে নাও - রাতে গান শুনাব। জীবনও হেসে ফেলে।

হাসতে হাসতে গড়াগড়ি!

২।
চাকুরী নিয়ে ভালই ছিল জীবন কিন্তু টাকার সংকট আর কাটে না। কয়েকটা চাকুরী পরিবর্তন করেও তেমন কোন লাভ হল না। ড্যাফোডিল, একমি, মোবারক মটরস, বেক্সিমকো। এভাবেই নানা অর্থ কষ্টে জীবন সাথীর সংসারে নুতন অতিথি আসে। ছেলেটা বড় হবার পাশাপাশি, জীবন সাথীর জীবনধারা ও বদলাতে থেকে। এখন আর তাদের মাদুর পেতে বসে রাতের খাবার খেতে হয় না। শেষ চাকুরীতে ভাল বেতন পেলে কিছু টাকা জমে যায়। সে টাকা নিয়ে গত ৪ বছর শেয়ার বাজারে ও বন্ধুদের সরকারী টেন্ডারে আনেষ্টনামি হিসাবে খাটিয়ে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা করে গেছে জীবন। মোটামুটি বলা যায়, বিবাহের ১৩ তম বছরে এখন জীবন সাথী অনেক পাকা সৈনিক। টাকার অভাব যেমন কেটেছে, তেমনি জীবন সাথী দুই জনের শরীরে ও মেদের পরিমানও বেড়েছে।

জীবন সাথীর সংসারটা এখন অনেক ঘুছানো। ঘরে কি নেই। হাতিলের খাট পালঙ্ক, ইন্ডিয়া থেকে আনা বম্বে ড্রাইংযের বিছানা ছাদর, আখতারের শোফা, বড় দুটো ফ্রীজ। কি নেই, সব কিছুই জীবন নিজের টাকায় কিনে ফেলেছে। শুধুমাত্র একটা টেলিভিশন ছাড়া! ড্রইং রুমের রাখা টেলিভিশনের কথা একটু বলা দরকার। গত ৯ বছর আগে এই এলজি গোল্ডেনআই টেলিভিশনটা সাথীর বাবা সাথীকে দিয়েছিলেন এই বলে যে, মেয়েটা সারাদিন একাএকা বাসায় থাকে। একদিন অফিস থেকে জীবন বাসায় ফিরে টেলিভিশনটা দেখে খুব রেগে গিয়েছিল। জীবন শশুরবাড়ী থেকে কোন কিছু নেয়া কখনো পশ্চন্দ করে নাই। সেদিন রাতে জীবন খুব কস্ট পেয়েছিল। সাথী জীবনকে ব্যাপারটা বুঝাতে অনেক চেষ্টা করেছিল।

বলা বাহুল্য, এখন চাইলেই জীবন একটা সনি ব্রাভিয়া টেলিভিশন কিনতে পারে, স্ট্যার্ডড চ্যার্টাড ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে ইন্টারেস্ট শূন্যে। একটা নুতন এলসিডি ওয়ালফিট। কয়েকবার জীবন কথাটা সাথীকে বলেছিল। সাথী কিছুতেই রাজী নয়, বাবার দেয়া টেলিভিশনটার প্রতি সাথীর একটা অন্য দুর্বলতা। টেলিভিশনটা দেখতে গেলেই নাকি বাবার কথা মনে পড়ে। জীবন সারা ঘরের নানা আসবাব পত্রে মাঝে মাঝে ধুলোবালি দেখলেও এই টেলিভিশনের উপর কখনো এমনটা দেখেনি। গত ৯ বছরে একই সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে এই যন্ত্রটা।

আজও প্রতিদিনের মত জীবন বাসায় ফিরে, ছেলেটার খোঁজ খরব নিয়ে একটা টানা গোসল দিয়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে। জীবন সাথী টেবিলের এপার ওপার, প্রতিদিনের মত আজো অনেক রান্না - ভাত, টাকি মাছের ভর্তা, পাতাকপি ভাঝি, শীম ফুলকপি নুতন আলু মিশিয়ে ঝরঝরে তরকারী, রুইমাছের ঝালকারী, দেশী মুরগীর সাধারন রান্না, মুশরীডাল।

হটাত ড্রইং রুম থেকে একটা বিকট শব্দে জীবন সাথী খাবার টেবিল থেকে ছুটে যায়। ছেলেটা শোফায় বসে আছে। টেলিভিশনের পিকচার টিঊব ভেঙ্গে পড়ছে, আগুনের ফুলকি। জীবন দ্রুত এগিয়ে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেয়। দেখেই বুঝা গেল, টেলিভিশনের মৃত্যু ঘটেছে! পরিবেশ শান্ত, জীবন সাথী খাবারের টেবিলের গিয়ে বসে। বিরাট গম্ভীর অবস্থা। জীবন সাথী দুইজনেই কি করবে বুঝতে পারছে না।

জীবন সাথীর পাতে ভাত তুলে দিয়ে টাকি মাছের ভর্তা এগিয়ে দেয়। সাথী চামুচ দিয়ে টাকি মাছের ভর্তা নিতে চেষ্টা করে, ভর্তার বাটি দোল খায়। এমন সময় জীবনের চোখে চোখ পড়ে যায় সাথীর। টাক মাথার জীবন হেসে ফেলে, খেয়ে নাও - রাতে গান শুনাব। সাথীও হেসে ফেলে।

হাসতে হাসতে গড়াগড়ি!

(প্রথম প্রকাশঃ আমরা বন্ধু)

জীবন সাথীঃ এক জোড়া মানুষ।

সকাল থেকে মন ভাল যাচ্ছিলো না। কি এক অজানা কষ্টে দুপুর পার হয়ে গেছে। কাজ কর্মে তেমন মনোযোগী ছিলাম না। ভাবলাম, দুপুরে ভাল খাবার খাই। আমার অফিস থেকে হাঁটা পথ ‘স্টার হোটেল’। স্টার হোটেল খাবার দাবারের ব্যাপারে ঢাকা শহরে নাম কামিয়েছে। এমন প্রেমিক প্রেমিকা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যারা স্টার কাবাব খায় নাই! টাকা কামিয়ে পুরাতন ঢাকা থেকে ধানমন্ডিতে বড় শাখা খুলেছে। ভাল মানের এবং পরিচ্ছন খাবার দাম দিয়ে খেতে মানুষের অভাব নেই। স্টার হোটেলে আরো কয়েকবার খেয়েছি, যখনই যাই মানুষের ভীড় চোখে পড়ে।

কোনায় একটা দুইজনের টেবিল ফাঁকা দেখে বসে পড়লাম। ওয়েটার ওয়ার্ডার নিতে আসতে পারছে না। ভীষন ব্যস্ততার মাঝে আছে। হোটেলে একা খেতে গেলে দাম পাওয়া যায় না। ওয়েটারা ভাবে, একজন মানুষ কি আর খাবে কিংবা কত টাকা টিপস দিবে! বেশী মানুষ নিয়ে গেলে ওরা হিসেবী কদর করে। স্যার স্যার বলে গলা শুকিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে হোটেল ওয়েটারদের মানসিকতা বদলানোর জন্য একটা কোচিং সেন্টার খোলা দরকার।

হোটেলে গেলেই ওয়েটার মনে করে, ব্যাটা জীবনে এই প্রথম হোটেলে এসেছে! ভাল খাবার জীবনে খায় নাই। আর সেজন্য প্রথমেই এক দমে কাচ্ছি বিরানী থেকে মুরগী মাসাল্লামে এসে থামে! সাক সবজি তো দূরে থাক, মাছের কথাও বলেতে চায় না। দামী খাবারে বিল বেশী, লজ্জায় হলেও তাকে বেশী টিপস দিতে হবে! ব্যাটারা এটা বুঝতে চায় না, আমাদের মত অনেক লোক আছে যারা বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন দুপুরে হোটেলে খাবার খায়। ঘর থাকতেও যারা পরবাসী!

সাদা ভাত, রুই মাছ আর পাতলা ডালের ওয়ার্ডার দিয়ে বসে আছি। মিনিট বিশেক পর হেলে দুলে ওয়েটার একবারেই সব নিয়ে এল। বেশ কৌশলী ওয়েটার, এত কিছু একবারেই দুই হাতে করে নিয়ে এসেছে। খাবার সাজিয়ে পানির কথা জানতে চায়, ঠান্ডা না নরমাল। এই গরমে ঠান্ডা হলেই ভাল হবে। তা ছাড়া আমার টনসিলাইটিস সমস্যা নেই! যত ঠান্ডা পারেন নিয়ে আসেন।

রুই মাছের পেটির টুকরাতে হাত লাগিয়ে কাটা দেখছিলাম। আমার পাশের টেবিলেই এক জোড়া মানুষ বসেছেন, একজন নারী, অন্যজন পুরুষ। এদের মধ্যে সম্পর্ক কি হতে পারে, বুঝা কিংবা আন্দাজ করা মুশকিল। খুবই আন্তরিক মনে হচ্ছে দুইজনকে। ছেলেটার সাথে মেয়েটাকে মানিয়েছে ভাল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জিন্স প্যান্ট ও গায়ে আকাশী রঙের টি সার্টে ছেলেটাকে ছবির নায়কের মতই মনে হচ্ছে।

আমার বসার জায়গা থেকে মেয়েটাকে খুব করে দেখা যায় না। উলটা করে বসা। তবে খোলা লম্বা চুল এবং দুই একবার মুখ ফেরানোর সময় চোহারা দেখেছি। বেশ সুন্দর। মেয়েটি হারিয়ে গেলে অনায়েশে পত্রিকায় এমন একটা বিজ্ঞপ্তি দেয়া যায় - মেয়েটির গায়ের রঙ শ্যামলা, মুখমণ্ডল গোলাকার, বয়স আনুমানিক পঁচিশ, উচ্চতা পাঁচ ফিট দুই। সোজা এক কথায় মায়াবী চেহারা।

এরা জীবন সাথী, প্রেমিক প্রেমিকা, স্বামী স্ত্রী না অন্য কিছু! খেতে খেতে ভাবছিলাম। রুই মাছের ঝোল না তেল! এটা হোটেল ওয়ালাদের কে বুঝাবে! এত তেল দিয়ে রান্না খাবার খেলে মানুষ বেশী দিন বাঁচে না রে পাগল! হার্ট, লিভার, কিডনী, রেক্টাম সহ শরীরের নানা অঙ্গে নানা অসুখ বাঁধে। সাদা ভাতে ডাল নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। আমি খাবার তাড়াতাড়ি খাই, সময় বাঁচানোর জন্য। খেতে বসে দুনিয়ার ফালতু আলাপের ঘোর বিরোধী আমি। আমার জীবন সংগী এ ব্যাপারে দারুন উলটা! আমি দুই ফুল প্লেট ভাত খেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে পনর মিনিট বিটিভি সংবাদ দেখে আসলেও দেখি তিনি চামুচ দিয়ে তরকারী নিচ্ছেন! সবই কপাল। তের বছরে তেরটা নৈতিকদিক বুঝাতে পারলাম না।

যাক। জীবন আসলে কারো জন্য থেমে থাকে না। রিঝিকের মালিক আল্লাহপাক। বাসায় রান্না না হলে রিঝিক হোটেল লিখা থাকে! কোথায় না কোথায় থাকবেই। মানুষ এই ভরশা নিয়েই বেঁচে থাকে। নানা ভাবনার ভীড়েও আমি মাঝে মাঝে ওই জোড়া মানুষ গুলো দেখছিলাম। ওদের খাওয়া শেষ, ওয়েটারকে বিল পরিশোধ করছে। উঠি উঠি করছে, আমিও শেষের দিকে আছি। ডালটা বেশ স্বাদের হয়েছে। বাসা হলে আর এক বাটী নিয়ে স্যুপের মত করে চালান দিতাম। হোটেলে ডাল এমন করে খেলে লোকে হাসবে! আর যদি মেয়েটা দেখে, লজ্জার সীমা থাকবে না! একটা ভাল লাগায় মনটা ভরে উঠছিল। সুখী মানুষ দেখলে ভাল লাগে।

একি। মেয়েটা যে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। টেবিলের তলায় রাখা দুটো ক্র্যাচ এগিয়ে দিচ্ছে ছেলেটা। ছেলেটা মেয়েটাকে ধরে দাঁড়া করিয়ে দিল। দুই হাতে দুটো ক্র্যাচ চেপে মেয়েটা এগিয়ে চলল। ওরা এগিয়ে যেতে থাকে। হায়, একি মেয়েটার একটা পা নেই!

সরলরেখা-বক্ররেখা : পঞ্চম পর্ব

লিখেছেনঃ সাহাদাত উদরাজী (তারিখঃ ২৫ আগষ্ট ২০১১, ৬:৪১ পূর্বাহ্ন) সরলরেখা-বক্ররেখা : চতুর্থ পর্ব    মিলিদের বিরাট বাসা। মিলির বাবা চাকুরী ক...