রবিবার, ৫ জুন, ২০১১

জীবন সাথীঃ জীবনের দুই ঘটনা।

১।
ঘটনা অনেক আগের, আপনাদের এই ঢাকা শহরের। বিবাহ করে জীবন সাথীকে নিয়ে সুখে দিনাতিপাত করছিল। টাকা পয়সার ব্যাপক প্রযোজনীয়তা তখনো নেই। জীবন একটা সাধারন চাকুরী করে, যা পায় তা দিয়ে কোন রকমে চলে যাচ্ছিলো। দুইজনই যেহেতু নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে ঘর বেধেছিল তাই চাওয়া পাওয়াও কম ছিল। তবে মাসের শেষে বাজার খরচে একটা হালকা টান পড়ে যেত, শেষ দুই চারদিন জীবনের পকেটে টাকা থাকত না। সোজাকথা জীবন ও সাথীর জীবনবোধ তখনো চাঙ্গা হয় নাই। এমনি একদিনে দু’জনে রাতের খাবার খেতে বসে, মাদুর পেতে - ভাত, লাল মরিচভর্তা আর পানিডাল।

আসলে সাথীর সে দিন আর কিছু করার ছিল না, এর ছেয়ে আর বেশী কিছু রান্নার সামগ্রী তার হাতে ছিল না। সকালে জীবনকে তরুতরকারীর কথা বলেছিল। জীবনও বলেছিল, চেষ্টা করবে। জীবন সেটা পারে নাই, অফিসে কারো থেকে ধার করে নিবে ভেবেছিলো কিন্তু কেমন একটা লজ্জায় তা আর করে নাই। খালিহাতেই বাসায় ফিরে গিয়েছিল।

সাথী জীবনের পাতে ভাত তুলে দিয়ে মরিচভর্তা এগিয়ে দেয়। জীবন চামুচ দিয়ে মরিচভর্তা নিতে চেষ্টা করে, ভর্তার বাটি দোল খায়। এমন সময় সাথীর চোখে চোখ পড়ে যায় জীবনের। ফর্সা টুকটুকে সাথী হেসে ফেলে, আজ খেয়ে নাও - রাতে গান শুনাব। জীবনও হেসে ফেলে।

হাসতে হাসতে গড়াগড়ি!

২।
চাকুরী নিয়ে ভালই ছিল জীবন কিন্তু টাকার সংকট আর কাটে না। কয়েকটা চাকুরী পরিবর্তন করেও তেমন কোন লাভ হল না। ড্যাফোডিল, একমি, মোবারক মটরস, বেক্সিমকো। এভাবেই নানা অর্থ কষ্টে জীবন সাথীর সংসারে নুতন অতিথি আসে। ছেলেটা বড় হবার পাশাপাশি, জীবন সাথীর জীবনধারা ও বদলাতে থেকে। এখন আর তাদের মাদুর পেতে বসে রাতের খাবার খেতে হয় না। শেষ চাকুরীতে ভাল বেতন পেলে কিছু টাকা জমে যায়। সে টাকা নিয়ে গত ৪ বছর শেয়ার বাজারে ও বন্ধুদের সরকারী টেন্ডারে আনেষ্টনামি হিসাবে খাটিয়ে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা করে গেছে জীবন। মোটামুটি বলা যায়, বিবাহের ১৩ তম বছরে এখন জীবন সাথী অনেক পাকা সৈনিক। টাকার অভাব যেমন কেটেছে, তেমনি জীবন সাথী দুই জনের শরীরে ও মেদের পরিমানও বেড়েছে।

জীবন সাথীর সংসারটা এখন অনেক ঘুছানো। ঘরে কি নেই। হাতিলের খাট পালঙ্ক, ইন্ডিয়া থেকে আনা বম্বে ড্রাইংযের বিছানা ছাদর, আখতারের শোফা, বড় দুটো ফ্রীজ। কি নেই, সব কিছুই জীবন নিজের টাকায় কিনে ফেলেছে। শুধুমাত্র একটা টেলিভিশন ছাড়া! ড্রইং রুমের রাখা টেলিভিশনের কথা একটু বলা দরকার। গত ৯ বছর আগে এই এলজি গোল্ডেনআই টেলিভিশনটা সাথীর বাবা সাথীকে দিয়েছিলেন এই বলে যে, মেয়েটা সারাদিন একাএকা বাসায় থাকে। একদিন অফিস থেকে জীবন বাসায় ফিরে টেলিভিশনটা দেখে খুব রেগে গিয়েছিল। জীবন শশুরবাড়ী থেকে কোন কিছু নেয়া কখনো পশ্চন্দ করে নাই। সেদিন রাতে জীবন খুব কস্ট পেয়েছিল। সাথী জীবনকে ব্যাপারটা বুঝাতে অনেক চেষ্টা করেছিল।

বলা বাহুল্য, এখন চাইলেই জীবন একটা সনি ব্রাভিয়া টেলিভিশন কিনতে পারে, স্ট্যার্ডড চ্যার্টাড ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে ইন্টারেস্ট শূন্যে। একটা নুতন এলসিডি ওয়ালফিট। কয়েকবার জীবন কথাটা সাথীকে বলেছিল। সাথী কিছুতেই রাজী নয়, বাবার দেয়া টেলিভিশনটার প্রতি সাথীর একটা অন্য দুর্বলতা। টেলিভিশনটা দেখতে গেলেই নাকি বাবার কথা মনে পড়ে। জীবন সারা ঘরের নানা আসবাব পত্রে মাঝে মাঝে ধুলোবালি দেখলেও এই টেলিভিশনের উপর কখনো এমনটা দেখেনি। গত ৯ বছরে একই সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে এই যন্ত্রটা।

আজও প্রতিদিনের মত জীবন বাসায় ফিরে, ছেলেটার খোঁজ খরব নিয়ে একটা টানা গোসল দিয়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে। জীবন সাথী টেবিলের এপার ওপার, প্রতিদিনের মত আজো অনেক রান্না - ভাত, টাকি মাছের ভর্তা, পাতাকপি ভাঝি, শীম ফুলকপি নুতন আলু মিশিয়ে ঝরঝরে তরকারী, রুইমাছের ঝালকারী, দেশী মুরগীর সাধারন রান্না, মুশরীডাল।

হটাত ড্রইং রুম থেকে একটা বিকট শব্দে জীবন সাথী খাবার টেবিল থেকে ছুটে যায়। ছেলেটা শোফায় বসে আছে। টেলিভিশনের পিকচার টিঊব ভেঙ্গে পড়ছে, আগুনের ফুলকি। জীবন দ্রুত এগিয়ে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেয়। দেখেই বুঝা গেল, টেলিভিশনের মৃত্যু ঘটেছে! পরিবেশ শান্ত, জীবন সাথী খাবারের টেবিলের গিয়ে বসে। বিরাট গম্ভীর অবস্থা। জীবন সাথী দুইজনেই কি করবে বুঝতে পারছে না।

জীবন সাথীর পাতে ভাত তুলে দিয়ে টাকি মাছের ভর্তা এগিয়ে দেয়। সাথী চামুচ দিয়ে টাকি মাছের ভর্তা নিতে চেষ্টা করে, ভর্তার বাটি দোল খায়। এমন সময় জীবনের চোখে চোখ পড়ে যায় সাথীর। টাক মাথার জীবন হেসে ফেলে, খেয়ে নাও - রাতে গান শুনাব। সাথীও হেসে ফেলে।

হাসতে হাসতে গড়াগড়ি!

(প্রথম প্রকাশঃ আমরা বন্ধু)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সরলরেখা-বক্ররেখা : পঞ্চম পর্ব

লিখেছেনঃ সাহাদাত উদরাজী (তারিখঃ ২৫ আগষ্ট ২০১১, ৬:৪১ পূর্বাহ্ন) সরলরেখা-বক্ররেখা : চতুর্থ পর্ব    মিলিদের বিরাট বাসা। মিলির বাবা চাকুরী ক...